শহীদ ওমর নুরুল আবছার ২০.০১.২০০২ ইং মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়াল খালী উপজেলার আকুবদন্ডী গ্রামে। তিনি ইংরেজি কারিকুলামে পড়াশোনা করেন। তার স্বপ্ন ছিলো, তিনি বিমানের ইন্জিনিয়ার হবেন। তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টন্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচ এস সি পরিক্ষা দিয়ে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তিনি এরপর Bangladesh Airlines Training Centre এ শেষ মডিউলে পড়ছিলেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করতে বাকি ছিলো মাত্র ৪ থেকে ৫ মাস। ইতিমধ্যে অনেকগুলো জব অপরচুনিটি তার হাতে এসেছিলো। কিন্তু তিনি সেদিকে তুয়াক্কা না করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রাজপথে থেকে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৮ ই জুলাই রাবার বুলেটে আহত হন। পরে ৫ই আগস্ট ২০২৪ বিজয় মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে তিনি উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটালে শাহাদাৎ বরণ করেন। শহীদ ওমর এর মা বলেন, ❝ ৩ টা ৩০ মিনিটে আমার সাথে কথা হয়। একটু পরে উত্তরায় ঝামেলা হচ্ছে শুনে ফোন করে শুনলাম ৩:৪৫ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ৬:২৬ মিনিটে ( ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী) শাহাদাত বরণ করেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। ফোনে সব দিকে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তাকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা করে নাই। পরে রাস্তায় কয়েকজন ছেলে মিলে তাকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটালে নিয়ে যায় এবং সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় শাহাদাৎ বরণ করে। এরপর আমরা যেতে পারি নাই যেহেতু পরিস্থিতি ভালো ছিলো না তাই গাড়ি পাচ্ছিলাম না। পরে তার বন্ধুরা এবং সিনিয়ররা একটা ফ্রিজার গাড়ী করে পাঠিয়ে দেয়। তারপর ভোর ৪টার দিকে আমরা আমার ছেলেকে রিসিভ করি।❞ তার মা তার সম্পর্কে বলেন, ❝আমার ছেলের স্বপ্ন ছিলো খুব উঁচু। ছোট বেলায় বলতাম, বাবা তুই neuro science নিয়ে পড়িস। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, আমার একটা সন্তানকে ডাক্তার বানাবো। তাই তাকে বলতাম। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিলো বিমান নিয়ে। ছোট বেলায় দেখতাম বিমান এর খেলনার বায়না দিতো। কিনে নিয়ে দিলে ৫ মিনিট এর ভেতরে পুরো খুলে পার্ট করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিতো। কত মার খেতো। তখন বুঝতাম না বিমান নিয়ে তার এত স্বপ্ন। তার স্বপ্ন ছিল দৃঢ়। যেই প্রতিজ্ঞা সেই কাজ করেছে । অভিউনিক্স এ ১৩ টা মডিউল আছে এক্সাম এর মত, যা দিতে হলে অনেক এক্সাম দেওয়া লাগে ওরাল টেস্ট and অন্যান্য। মডিউল দেওয়া মানুষের স্বপ্ন থাকে। আমার ছেলে এক চান্সে সব পার করেছে। এক বারে প্রত্যেকটাতেই উত্তীর্ণ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ!আগামী এক মাস পর তার চাকরি। আমি গ্রীষ্ম কালে অতিরিক্ত তাপে অসুস্থ হয়ে যায়। তাই সে বলেছিল, আম্মু! আমার ফার্স্ট স্যালারি দিয়ে তোমাকে AC কিনে দিবো। সেকেন্ডে আব্বু কে প্রবাস থেকে আনবো। আম্মু! তোমাদের জন্য একটি ডুপ্লেক্স ঘর বানাবো। ওইখানে থাকবে গ্রামীণ পরিবেশ। তোমরা নেচার এর সাথে থাকলে সুস্থ থাকবে। তার ইচ্ছে ছিল একটি মসজিদ করা যেখানে নামাজ পড়লে মানুষকে সম্মানিত করা হবে।গরিবদের সাহায্য করা হবে। ছোটদের চকলেট দেওয়া হবে। আমার বাচ্চাটা কিছুই করতে পারলো না। আন্দোলনে তার জার্নি শুরু হয় জুলাই এর ১০ তারিখ থেকে। আমার বাচ্চা কখনও কোনো রাজনীতি করতো না, বুঝতোও না। একদিন পথে হেঁটে যাচ্ছিল, তার পাশে একটা চাকরীজীবি বয়স্ক মানুষ ছিলো, তাকে পুলিশ গুলি করেছিল । সাথে সাথেই মারা যায়। এই দৃশ্য সে ভুলতে পারে নি। আমাকে বলতো, আম্মু! মেনে নেওয়া যায় না, কত নিরীহ প্রাণ চলে গেলো! আমি সব সময় বলতাম, বাবা কোথাও যাস না। এই মৃত্যুর দায় নেবে না কেউ। আমার বুক খালি করিস না। কিন্ত আমার বাচ্চা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে নি। আমাকে না জানিয়ে সে চলে গেছে। আমি কল দিলে আমাকে সান্তনা দিতো। আম্মু! আমি ঘর থেকে বেরই হই না। তুমি চিন্তা করো না। এর মধ্যে একবার পুলিশের রাবার বুলেট লাগে। অসুস্থ হয়ে যায়। আমাকে তাও বললো না। আমি বাসায় চলে আসতে বললে বলে, আম্মু! আমার ক্লাস আছে। আন্দোলনের পর আসবো। আমার ছেলে ৬ তারিখ আমার কাছে আসার কথা বলেছিলো। কিন্তু তারা আমার ছেলে কে আমার কাছে আসতে দেয় নি। এর মধ্যে পুলিশ এরেস্ট করেছিল, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো bad কিছু না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল তার বন্ধুদের মতে তারা টাকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ওই দিন একই সাথে তার বন্ধুকেও অ্যারেস্ট করে। তাকে জামাত সন্দেহে থানায় নিয়ে অত্যাচার করে, রিমান্ডে নিয়ে যায়।আমার ছেলে সহ তার বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করে পুলিশের কাছ থেকে আনতে পারে নি। অবশেষে আনন্দ মিছিলের পর পুলিশের কাছে যায় তারা তার বন্ধুকে নিয়ে যেতে। তখন পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়, থানাটি হলো উত্তরা থানা। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করে । মারধর করে। এর মধ্যে আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। তারা তার পরিচিত ছিলো না। সেই মুহূর্তে আমার ছেলে ঢলে পড়ে যায় । ২০ মিনিট ঐভাবে রয়ে যায়। এক সময় একটা পথের মানুষ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে । তখন সে আমার ফোন নম্বর দেয় । ওই মানুষটা আমাকে ফোন করে। তখন আমরা অনেক চেষ্টা করি ফোনে, তাকে যেন কোনো হাসপাতালে নিয়ে যায়। এক সময় তারা বাংলাদেশ মেডিকেল এ নিয়ে যায় । কিন্তু ওরা কোনো আহত ছাত্র কে এডমিশন দেয় নি। সবাই কে একইভাবে তাড়িয়ে দেয় । কোনো যানবাহন ছিলো না ।পরে তার বন্ধুরা এবং সেই মানুষটা ধরে ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এ নিয়ে যায় । ওইখানে আমার ছেলে শহীদ হয়। ওরা বাঁচতে দিলো না আমার বাবাকে। আমার বাচ্চাটা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু বুঝত না। মানুষের মৃত্যু নিতে না পেরে, দেশের জন্য এবং বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই চলে গেলো। স্বপ্ন ছিলো বিমান বানিয়ে মানুষকে আকাশে উড়িয়ে নেওয়ার। কিন্তু সে নিজেই উড়াল দিলো। আমার বুক খালি করে চলে গেলো । এই মৃত্যুর দায় কে নেবে !!! আমার ছেলে এবং যারা শহীদ হয়েছে তারা কি বিচার পাবে ?❞